ডিভোর্স বা তালাকের আইনি পদ্ধতি কী?

ডিভোর্স বা তালাকের আইনি পদ্ধতি কী?

বাংলাদেশে ডিভোর্স বা তালাক একটি বৈধ ও আইনসম্মত প্রক্রিয়া, যা মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ, ১৯৬১ এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। নিচে মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য তালাকের আইনি পদ্ধতি ধাপে ধাপে ব্যাখ্যা করা হলো:


মুসলিম স্বামী কর্তৃক তালাক (Talaq by Husband)

ধাপ ১: তালাকের ঘোষণা

স্বামী স্ত্রীর প্রতি স্পষ্টভাবে তালাক দেয়ার ঘোষণা দেন (মৌখিক/লিখিত)।

এটি হতে পারে “আমি তোমাকে তালাক দিলাম” এ ধরনের বাক্যে।


ধাপ ২: লিখিত নোটিশ পাঠানো (ধারা ৭)

স্বামীকে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বা পৌরসভার মেয়র/কর্মকর্তার কাছে লিখিত নোটিশ পাঠাতে হয় তালাক ঘোষণার বিষয়ে।

একই সঙ্গে স্ত্রীকেও তালাকের একটি অনুলিপি (copy) পাঠাতে হয়।


ধাপ ৩: সালিশ বোর্ড গঠন (Arbitration Council)

চেয়ারম্যান ৩০ দিনের মধ্যে সালিশ বোর্ড গঠন করেন স্বামী ও স্ত্রীর পক্ষ থেকে প্রতিনিধিসহ।


ধাপ ৪: ৯০ দিন অপেক্ষা (Iddat Period)

তালাক কার্যকর হতে ৯০ দিন বা স্ত্রীর গর্ভাবস্থার অবসান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

এই সময়ের মধ্যে পুনর্মিলন হলে তালাক বাতিল হয়।


ধাপ ৫: তালাক কার্যকর

৯০ দিন পর যদি পুনর্মিলন না হয়, তালাক বৈধ ও কার্যকর হয়।


মুসলিম স্ত্রীর তালাকের অধিকার (Talaq by Wife)

স্ত্রী তালাক দিতে চাইলে দুটি উপায় আছে:


১. Talaq-e-Tafweez (প্রতিনিধিত্বমূলক তালাক)

স্বামী যদি নিকারনামায় স্ত্রীকে তালাকের অধিকার দিয়ে থাকেন, তাহলে স্ত্রীও উপরের ধাপগুলো অনুসরণ করে তালাক দিতে পারেন।


২. ফাসখ (বিচ্ছেদ চাওয়া) – পারিবারিক আদালতে মামলা

যদি তালাকের অধিকার না থাকে, তবে স্ত্রীকে পারিবারিক আদালতে বিবাহবিচ্ছেদ মামলা (Divorce Suit) করতে হবে।

যৌক্তিক কারণ থাকতে হবে, যেমন: নির্যাতন, ভরণপোষণ না দেওয়া, স্বামী নিখোঁজ ইত্যাদি।


আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ (উভয় পক্ষের সম্মতিতে)

যদি স্বামী-স্ত্রী উভয়ে সম্মত হন, তাহলে আদালতে যৌথভাবে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন (Mutual Consent Divorce) করা যেতে পারে।


ডিভোর্স বা তালাকের আইনি প্রক্রিয়া বাংলাদেশে মুসলিম আইন ও প্রচলিত আইন অনুযায়ী হয়ে থাকে। সাধারণত, স্বামী বা স্ত্রী যে কেউ বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করতে পারেন, তবে স্ত্রীর জন্য কিছু বিশেষ শর্ত প্রযোজ্য হতে পারে। 

ডিভোর্সের আইনি প্রক্রিয়াটি হলো:

১. নোটিশ প্রদান: প্রথমে, তালাকের নোটিশ স্বামী বা স্ত্রী কর্তৃক সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা এলাকার designated কাজী অফিসে পাঠাতে হবে। 

২. সালিশি পরিষদ গঠন: নোটিশ পাওয়ার পর, সিটি কর্পোরেশন বা পৌরসভা একটি সালিশি পরিষদ গঠন করবে, যার কাজ হবে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের মধ্যে মীমাংসার চেষ্টা করা। 

৩. ৯০ দিনের সময়সীমা: নোটিশ পাঠানোর পর ৯০ দিনের একটি সময়সীমা থাকে, এই সময়ের মধ্যে যদি কোনো মীমাংসা না হয়, তবে তালাক কার্যকর হবে। 

৪. কাবিননামা: কাবিননামা (বিবাহের চুক্তিপত্র) থাকলে সেটি ব্যবহার করে তালাকনামা তৈরি করা যায়। যদি কাবিননামা না থাকে, তাহলে এফিডেভিট করে বিবাহের প্রমাণ দিতে হবে। 

৫. আবেদন: যদি স্বামী-স্ত্রী কেউ মীমাংসায় আসতে না পারেন, তবে যে কেউ আদালতের মাধ্যমেও বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য আবেদন করতে পারেন। 

৬. কারণ উল্লেখ: ডিভোর্সের জন্য আবেদন করার সময়, কিছু যুক্তিসংগত কারণ উল্লেখ করতে হয়, যেমন- স্বামীর নিষ্ঠুরতা, ভরণপোষণ প্রদানে ব্যর্থতা, বা মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতা ইত্যাদি। 

৭. স্বামীর জন্য প্রযোজ্য নিয়ম: মুসলিম আইনে, স্বামীকে সরাসরি তালাক দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তবে স্ত্রীর ক্ষেত্রে ১৮ নম্বর কলামে উল্লেখ থাকলে স্ত্রীও ডিভোর্স দিতে পারেন। 

ডিভোর্সের এই প্রক্রিয়াটি মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন, ১৯৭৪ অনুযায়ী হয়ে থাকে। 


তালাকের পরে করণীয়

তালাকের পরে করণীয় বিষয়ে বিস্তারিত জানাচ্ছি, বিশেষ করে বাংলাদেশে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রেক্ষাপটে, কারণ তালাকের পরে অনেক আইনি, সামাজিক ও আর্থিক বিষয় গুরুত্ব বহন করে।

১. ইদ্দত পালন (Iddat Period)

তালাকের পর স্ত্রীকে ৩ মাস বা গর্ভাবস্থা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

এই সময়কে ‘ইদ্দত’ বলে। এর মধ্যে স্ত্রী পুনরায় বিয়ে করতে পারবেন না।

ইদ্দতের উদ্দেশ্য: গর্ভধারণ থাকলে সন্তানের সঠিক পিতা নির্ধারণ ও পুনর্মিলনের সম্ভাবনা দেওয়া।


২. মোহরানা প্রদান (Mahr)

তালাকের সময় মোহর (বিবাহের সময় নির্ধারিত উপহার বা টাকা) এখনও বকেয়া থাকলে স্বামীকে তা দিতে হয়।

মোহর না দিলে স্ত্রী আইনি দাবি করতে পারেন।


৩. ভরণপোষণ (Maintenance)

তালাকের পর স্বামীকে স্ত্রীর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ ভরণপোষণ দিতে হয়।

যদি স্ত্রী সন্তানদের কেয়ার করে, তবে সন্তানের খরচও স্বামীকে দিতে হয়।

আইন অনুসারে, ভরণপোষণ দেওয়া স্বামীর বাধ্যবাধকতা।


৪. সন্তানের হেফাজত ও পরিচর্যা (Custody)

সন্তানের যত্ন ও হেফাজতের জন্য পারিবারিক আদালতে মামলা করা যেতে পারে।

সাধারণত ছোট সন্তানের হেফাজত মায়ের কাছে থাকে, বড় হলে বাবার হেফাজতে চলে যেতে পারে।


৫. আর্থিক ও সম্পত্তি বিষয়ক সিদ্ধান্ত

তালাকের পর সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা বা ভরণপোষণ বিষয়ক বিরোধ হলে দেওয়ানি আদালতে মামলা করা যায়।


৬. বিবাহবিচ্ছেদ ও তালাক নথিপত্র সংরক্ষণ

তালাকের নোটিশ ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিক কাগজপত্র ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে হবে।

ভবিষ্যতে আইনি প্রয়োজনে এই নথিগুলো দরকার হতে পারে।


৭. নতুন জীবন শুরু ও সামাজিক ব্যবস্থাপনা

তালাকের পর মানসিক ও সামাজিক সহায়তা প্রয়োজন হতে পারে।

পরিবারের এবং সমাজের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা গুরুত্বপূর্ণ।


আইনি সাহায্য ও পরামর্শ

তালাকের পর পারিবারিক আদালত বা আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করা জরুরি।

বিশেষ করে সন্তান হেফাজত, ভরণপোষণ, সম্পত্তি ও মোহর সংক্রান্ত বিষয়ে।


সংক্ষিপ্ত টেবিল

তালাকের পরে করণীয়:

ইদ্দত: তালাকের পর ৩ মাস/গর্ভাবস্থা শেষ হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী অপেক্ষা করবেন

মোহরানা: স্বামীকে মোহর প্রদান করতে হবে (তালাক হলে অবশিষ্ট পুরোটাই দিতে হয়)

ভরণপোষণ: স্ত্রী এবং সন্তানদের ভরণপোষণ দিতে হয়, বিশেষ করে সন্তানদের ক্ষেত্রে

সন্তানের হেফাজত: সন্তানের হেফাজতের জন্য পারিবারিক আদালতে আলাদা মামলা হতে পারে

সম্পত্তি: বিরোধ থাকলে দেওয়ানি আদালতে মামলা

নথিপত্র: তালাক সংক্রান্ত সকল কাগজপত্র সংরক্ষণ

সামাজিক ও মানসিক: নতুন জীবন শুরু ও সমর্থন গ্রহণ


উদাহরণ:

একজন স্বামী তার স্ত্রীকে মৌখিকভাবে তালাক দিয়ে দেন কিন্তু ইউনিয়ন চেয়ারম্যানকে জানায় না – এই তালাক আইনত অবৈধ।

আইন অনুযায়ী, লিখিত নোটিশ এবং ৯০ দিনের সময় না পার হলে তালাক কার্যকর হয় না।