ফৌজদারি মামলা ও দেওয়ানি মামলার মধ্যে পার্থক্য কী?
ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো, ফৌজদারি মামলায় রাষ্ট্র পক্ষ থেকে ব্যক্তির বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার করা হয়, যেখানে দেওয়ানি মামলায় ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অধিকার, সম্পত্তি বা চুক্তি নিয়ে বিরোধের মীমাংসা করা হয়।
ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলার মধ্যেকার প্রধান পার্থক্যগুলো হলো:
বিষয়বস্তু:
ফৌজদারি মামলায়, অপরাধ (যেমন: চুরি, মারামারি, হত্যা ইত্যাদি) যা সমাজের শান্তি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে, তার বিচার করা হয়।
দেওয়ানি মামলায়, ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যেকার অধিকার, সম্পত্তি বা চুক্তি সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ে আলোচনা করা হয়।
পক্ষসমূহ:
ফৌজদারি মামলায়, সরকার (রাষ্ট্র) বাদী এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি বা ব্যক্তিরা বিবাদী হন।
দেওয়ানি মামলায়, বাদী এবং বিবাদী উভয়ই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান হতে পারে।
লক্ষ্য:
ফৌজদারি মামলার লক্ষ্য হলো অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া এবং সমাজের শান্তি ফিরিয়ে আনা।
দেওয়ানি মামলার লক্ষ্য হলো বিবাদ মীমাংসা করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
ফলাফল:
ফৌজদারি মামলায়, অপরাধ প্রমাণ হলে অভিযুক্ত ব্যক্তির শাস্তি হতে পারে (যেমন: জরিমানা, কারাদণ্ড)।
দেওয়ানি মামলায়, আদালত সাধারণত ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশ দেয়।
সংক্ষেপে, ফৌজদারি মামলা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে করা হয় এবং এর লক্ষ্য শাস্তি দেওয়া, যেখানে দেওয়ানি মামলা দুটি পক্ষের মধ্যে অধিকারের জন্য করা হয় এবং এর লক্ষ্য হলো ক্ষতিপূরণ দেওয়া।
ফৌজদারি মামলা (Criminal Case) ও দেওয়ানি মামলা (Civil Case)-এর মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে।
নিচে সেগুলো সংক্ষেপে তুলনামূলকভাবে তুলে ধরা হলো:
ফৌজদারি মামলা
সংজ্ঞা: রাষ্ট্র বা সরকার কর্তৃক দণ্ডনীয় অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা
উদ্দেশ্য: অপরাধের বিচার ও অপরাধীকে শাস্তি প্রদান
বাদী: সাধারণত রাষ্ট্র (সরকার), যা পুলিশ বা সরকারি কৌঁসুলির মাধ্যমে পরিচালিত হয়
অভিযোগের ধরন: হত্যাকাণ্ড, ডাকাতি, ধর্ষণ, জালিয়াতি, চুরি ইত্যাদি অপরাধ
শাস্তির ধরণ: জেল, জরিমানা, মৃত্যুদণ্ড ইত্যাদি
প্রমাণের মানদণ্ড: অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হতে হবে ("Beyond reasonable doubt")
মামলার নামকরণ: রাষ্ট্র বনাম অভিযুক্ত (State vs. Accused)
আদালত: দায়রা (Sessions) বা ম্যাজিস্ট্রেট আদালত
ফলাফল: দণ্ড বা শাস্তি
দেওয়ানি মামলা
সংজ্ঞা: ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অধিকার সংক্রান্ত বিরোধের মামলা
উদ্দেশ্য: ব্যক্তিগত অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও ক্ষতিপূরণ প্রাপ্তি
বাদী: ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা, যার অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে
অভিযোগের ধরন: জমির মালিকানা, দেনা-পাওনা, চুক্তি লঙ্ঘন, বিবাহবিচ্ছেদ ইত্যাদি অধিকার সম্পর্কিত সমস্যা
শাস্তির ধরণ: ক্ষতিপূরণ, আদেশ বাস্তবায়ন, নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি
প্রমাণের মানদণ্ড: অধিকতর সম্ভাব্যতা বা ভারসাম্য ("Preponderance of evidence")
মামলার নামকরণ: বাদী বনাম বিবাদী (Plaintiff vs. Defendant)
আদালত: দেওয়ানি (Civil) আদালত
ফলাফল: ক্ষতিপূরণ বা প্রতিকার
উদাহরণ:
ফৌজদারি মামলা: কেউ চুরি করেছে – পুলিশ মামলা করে, অভিযুক্ত প্রমাণিত হলে তাকে শাস্তি দেওয়া হয়।
দেওয়ানি মামলা: দুই ভাইয়ের মধ্যে জমি নিয়ে বিরোধ – আদালতে দেওয়ানি মামলা হয়, আদালত জমির মালিক নির্ধারণ করে।
বাংলাদেশের আইনি প্রেক্ষাপটে ফৌজদারি এবং দেওয়ানি মামলার কিছু নির্দিষ্ট আইন ও বাস্তব উদাহরণ নিচে দেওয়া হলো:
ফৌজদারি মামলা – বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে
প্রধান আইন:
দণ্ডবিধি, ১৮৬০ (Penal Code, 1860)
→ এটি বাংলাদেশের ফৌজদারি অপরাধের মূল আইন।
উদাহরণ: হত্যাকাণ্ড (ধারা ৩০২), চুরি (ধারা ৩৭৮), জালিয়াতি (ধারা ৪৬৩), ইত্যাদি।
ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ (Criminal Procedure Code, 1898)
→ মামলার তদন্ত, বিচার প্রক্রিয়া, জামিন, গ্রেফতার ইত্যাদি কিভাবে হবে তা নির্ধারণ করে।
বাস্তব উদাহরণ:
রাষ্ট্র বনাম জনৈক আসামী (State vs. Mr. X):
যদি কেউ হত্যা করে, তাহলে পুলিশ একটি মামলা রুজু করে, আদালতে রাষ্ট্র পক্ষে মামলা পরিচালনা করে এবং দোষী প্রমাণিত হলে আসামী শাস্তি পায়।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০
ধর্ষণ, যৌন নির্যাতন বা এসিড নিক্ষেপের মতো অপরাধে এই আইনে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ফৌজদারি মামলা হয়।
দেওয়ানি মামলা – বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে
প্রধান আইন:
দেওয়ানি কার্যবিধি, ১৯০৮ (Civil Procedure Code, 1908)
→ দেওয়ানি মামলা পরিচালনার নিয়মাবলি।
ট্রান্সফার অব প্রপার্টি অ্যাক্ট, ১৮৮২
→ জমি বা সম্পত্তি হস্তান্তরের নিয়ম নির্ধারণ করে।
সুনির্দিষ্ট প্রতিকার আইন, ১৮৭৭ (Specific Relief Act, 1877)
→ কোনো চুক্তি বাস্তবায়নে আদালতের হস্তক্ষেপের ব্যবস্থা।
বাস্তব উদাহরণ:
জমি নিয়ে বিরোধ: দুই পক্ষের মধ্যে জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ হলে একজন দেওয়ানি আদালতে মামলা করতে পারেন জমি ফেরতের জন্য বা মালিকানা স্বীকৃতির জন্য।
চুক্তিভঙ্গ: আপনি যদি কারো সঙ্গে একটি ফ্ল্যাট কেনার চুক্তি করেন, কিন্তু বিক্রেতা সেই ফ্ল্যাট না দেয়, তাহলে আপনি Specific Relief Act অনুযায়ী দেওয়ানি মামলা করতে পারেন।
সংক্ষেপে:
ফৌজদারি আইন: রাষ্ট্র বনাম অপরাধী → লক্ষ্য: শাস্তি
দেওয়ানি আইন: ব্যক্তি বনাম ব্যক্তি → লক্ষ্য: অধিকার রক্ষা ও ক্ষতিপূরণ